পাতাল রেল, সাবওয়ে,আন্ডার গ্রাউন্ড বা মেট্রো যে নামেই ডাকা হোক না কেন এটি আধুনিক যোগাযোগ ব্যবস্তার এক বৈপ্লবিক মাধ্যম। পাতাল রেল পৃথিবীর বিভিন্ন বড় বড় শহরকে যানজটের অসহনীয় যন্ত্রণা থেকে মুক্তি দিতে অভাবনীয় ভূমিকা পালন করে আসছে। ২০১৪ সালের জানুয়ারী পর্যন্ত বিশ্বের ৫৪ টি দেশের ১৯০ টি পাতাল রেলের পরিসংখ্যান পাওয়া যায়। এর মধ্যে ইউরোপের দেশগুলোই সবচেয়ে সমৃদ্ধ। আবার ইউরোপের সবচেয়ে শক্তিশালী পাতাল রেলের মধ্যে প্যারিস মেট্রো সার্ভিস অন্যতম। মস্কোর পর এটি ইউরোপের দ্বিতীয় ব্যস্ততম পাতাল রেল সার্ভিস। ২০১২ সালের হিসাব অনুযায়ী প্যারিস মেট্রো দিয়ে বছরে ১.৫৪১ বিলিয়ন যাত্রী যাতায়াত করে যা ক্রমেই বৃদ্ধি পাচ্ছে।
প্যারিসের মেট্রো রেলের ইতিহাস অনেক পুরনো। উনবিংশ শতাব্দীর গুড়ার দিক থেকে এর পরিকল্পনা শুরু হয় যখন প্যারিস মেট্রোপলিটন এলাকা প্রায়ই যানজটে প্যারালাইসড হয়ে থাকত। এই অসহনীয় যানজট থেকে শহরকে মুক্ত করার লক্ষ্যে পাতাল রেলের চিন্তা শুরু হয়। প্রায় অর্ধ শতাব্দী ধরে চলতে থাকে মেট্রোরেল তৈরির নানামুখী প্রচেষ্টা। অবশেষে দীর্ঘ প্রতীক্ষিত মেট্রো রেল পরিকল্পনা, আলোর মুখ দেখে ১৯০০ সালে। এ বছরের ১৯ জুলাই সাফল্যের সাথে প্যারিসের প্রথম মেট্রো লাইন যাত্রা শুরু করে। এ সাফল্যের পর প্যারিস শহর কর্তৃপক্ষ পাতাল রেলের মহা পরিকল্পনা হাতে নেয়। প্রকৌশলী Fulgence Bienvenüe এর পরিকল্পনা ও তত্ত্বাবদানে চলতে থাকে মেট্রো রেলের অগ্রযাত্রা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর যা পূর্ণতা পায়। ১৯৯৮ সালে, ১৪ নম্বর মেট্রোটি কোন ড্রাইভার ছাড়া অধ্যাধুনিক প্রযুক্তির মাধ্যমে পরিচালনা করে প্যারিস মেট্রো সার্ভিস এক নতুন দিগন্তের সূচনা করে। এরপর ২০১৪ সালে ১ নং মেট্রো লাইনও অটোম্যাটিক সিস্টেমের আওতায় নিয়ে আসা হয়েছে। এছাড়া মেট্রো লাইন ৪ কেও একি সিস্টেমের আওতায় নিয়ে আসার কাজ চলছে।
প্যারিসের অধিকাংশ মেট্রো মাটির নিচ দিয়ে চলাচল করে। মেট্রো সার্ভিসটি ২১৪ কিলোমিটার ব্যাপী বিস্তৃত এবং ৩০৩ টি মেট্রো স্টেশন রয়েছে এ সার্ভিসের। ষ্টেশনগুলোর ৬২টিতে রয়েছে একাধিক লাইন যার মাধ্যমে যাত্রীরা এক লাইন পরিবর্তন করে অন্য অন্য লাইন ধরে নির্দিষ্ট গন্তব্যে যেতে পারেন। প্যারিসে মোট ১৬টি মেট্রো লাইন রয়েছে। এগুলো ১,২ থেকে ১৪ নম্বর পর্যন্ত নাম্বারিং করা হয়েছে। এছাড়া ৩বি এবং ৭বি নামে দুটি ছোট মেট্রো লাইন রয়েছে। মেট্রো লাইনগুলো বিভিন্ন কালারের মাধ্যমে পৃথক করা হয়েছে। প্রতিটি লাইনের প্রথম ও শেষ ষ্টেশনের মাধ্যমে নির্দিষ্ট লাইনের শুরু ও গন্তব্যকে বুঝানো হয়েছে। মেট্রোগুলো প্রতিদিন ভোর সাড়ে পাঁচটায় সার্ভিস শুরু করে এবং রাত দেড়টায় শেষ করে। এছাড়া উইকেন্ডের আগের রাত ও যে কোন ব্যাংক হলিডের আগের রাত্রে তা রাত ২টা পর্যন্ত চালু থাকে।
বিশ্বের সর্ব বৃহৎ মেট্রো ষ্টেশন Gare de Châtelet – Les Halles
প্যারিসের Gare de Châtelet – Les Halles বিশ্বের সর্ব বৃহৎ Metro Station। এটি প্যারিসের অনেকগুলো প্রধান মেট্রো স্টেশনের একটি। এটি Châtelet এবং Les Halles নামের দুটি ষ্টেশনের সাথে সরাসরি সংযুক্ত। প্রতিদিন প্রায় ৭৫০ ০০০ যাত্রী এ ষ্টেশন দিয়ে যাতায়াত করে থাকেন। এ ষ্টেশন থেকে আপনি তিনটি RER (Île De France এর সাথে সংযোগকারী লাইন) লাইনের সেবা নিতে পারেন। এছাড়া এ স্টেশন থেকে মেট্রো লাইন ১,৪,৭,১১ এবং ১৪ এর যে কোনটি ধরতে পারেন। এটি ১৯৭৭ সালে সাধারনের জন্য খুলে দেয়া হয়। ষ্টেশন দিয়ে প্রতি ঘণ্টায় ১২০ টি ট্রেন যাতায়াত করে। বর্তমানে ষ্টেশনটিতে মেরামতের কাজ চলছে। ২০১১ সাল থেকে শুরু হওয়া এই মেরামত কাজ ২০১৬ সালে শেষ হবে।
এ বছরের ১৬ অক্টোবর ইউরোপের সবচেয়ে প্রাচীন রেলস্টেশন হিসাবে প্যারিসের “গার দ্যু নর্দ” তার ১৫০ তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী পালন করে। ১৮৬৪ সালের ১৬ অক্টোবর এ স্টেশনটি রেল চলাচলের জন্য উন্মুক্ত করে দেয়া হয়। ফ্রান্সের উত্তরে অবস্থানরত দেশগুলোর সঙ্গে রেলপথে যোগাযোগের জন্য গার দ্যু নর্দ নামের স্টেশনটির কাজ শুরু হয় ১৮৬১ সালে। ১৮৬৪ সালের ১৬ অক্টোবর স্টেশনটিতে রেল চলাচল শুরু হয়। ফরাসী স্থপতি জ্যাক হিতরফ গার দ্যু নর্দের নকশা প্রনয়ন করেন। ১৮৮৯ সালে স্টেশনটি পুর্ননির্মান করা হয়।
বর্তমানে গার দ্যু নর্দ স্টেশন ব্যবহারকারী যাত্রীর সংখ্যা বছরে ১৯ কোটি ৬০ লাখেরও বেশী। স্টেশনটিতে মোট ৩৬ টি প্লাটফরম রয়েছে। গার দ্যু নর্দ স্টেশন থেকে প্রতিদিন বেলজিয়াম, জার্মানী, হল্যান্ড ও ইংলন্ডের উদ্দেশ্যে ইউরোস্টার ট্রেন ছেড়ে যায়। এছাড়া মেট্রো রেল, আঞ্চলিক যোগোযোগের ট্রেন, টিজিভি নিয়মিত চলাচল করে।
ইউরাপের সবচেয়ে প্রাচীন এ স্টেশনটি শুধু রেল চলাচলের জন্যই না, দ্য ভিঞ্চি কোড সহ বিভিন্ন চলচ্চিত্রের গুরুত্বপূর্ণ দৃশ্যায়নের জন্যও বিখ্যাত।