আপনি আছেন » প্রচ্ছদ » খবর

জনপ্রিয় রম্য লেখক আসিফ মেহেদীর 'মায়া' - সকল পর্ব

আসিফ মেহেদী বাংলাদেশের অন্যতম সফল রম্য লেখক, আসিফ মেহেদীর সেরা লেখার একটি মায়া । বাংলানিউজলাইভের পাঠকদের জন্য আজ আমরা প্রকাশ করছি, মায়া র প্রথম পর্ব। 

এটি আসিফ মেহেদীর লেখা দ্বিতীয় উপন্যাস। ২০১৫ সালে জাগৃতি প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত হয়েছিল। পাঠকবন্ধুদের ভালোবাসার ফলে ২০১৫ সালে বেস্ট সেলার উপন্যাস হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছিল।

মায়া পর্ব - ১


নিজামউদ্দিন হাসিমুখে অশ্বমানব কে দেখছেন। তার জন্য হাসিমুখ না বলে স্বাভাবিক মুখ বলা যেতে পারে! কারণ তার মুখের গড়নই এমন। যেকোনো সময় তার দিকে তাকালে মনে হয় মানুষটা হাসিখুশি ভঙ্গিতে আছেন। কোনো দুর্ঘটনার খবর বা মৃত্যুসংবাদ কেউ তাকে দিতে এলে প্রথমে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যায়। বার্তাবাহক চরম আফসোসের সুরে কথাগুলো বললেও নিজামউদ্দিনের হাসিমুখ যেন বলে ওঠে প্রেজেন্ট স্যার ! তখন ব্যাপারটি হয়ে ওঠে দ্বিগুণ হাস্যকর।
অশ্বমানব নামটি তারই দেওয়া। এক যুবক সকাল থেকে তার বাড়ির সামনে কড়া রোদে দাঁড়িয়ে আছে। ছেলেটির হাতে ফুল আর গিফটের প্যাকেট। দূর থেকে মনে হচ্ছে, দাঁড়িয়েই ঘুমিয়ে পড়েছে। আগেও বেশ কয়েকদিন এই কাজটি সে যত্নের সঙ্গে করেছে। ফিটফাট ফুলবাবু সেজে ফুল-গিফট হাতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থেকেছে। পৃথিবীর সবচেয়ে শান্তিপূর্ণ কর্মসূচি ঘুম এই ঘুমের কাজটি ঘোড়া দাঁড়িয়েই সারে! তাই নিজামউদ্দিন ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থাকা ছেলেটির নাম রেখে দিয়েছেন অশ্বমানব ।
নিজাম সাহেব দোতলার বারান্দায় বসে আছেন। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত এখানে তিনি এভাবেই বসে থাকেন। এজন্য নিজেরও একটি নাম দিয়েছেন; গুল্মমানব । তিনি নিজেকে লতা-গুল্মের মতোই অতি সাধারণ মনে করেন। তাছাড়া গুল্ম যেমন চলৎশক্তিহীন জীব, তেমনি তিনিও সারাদিন খুব একটা হাঁটাচলা করেন না। বাসায় কেউ না এলে তিনি এখানে বসেই বই পড়েন, পেপার পড়েন, কিছুক্ষণ পরপর চা খান। আগে গ্রিন টি ছিল তার ফেবারিট। ইদানীং মিন্ট টি পান করেন।
গুল্মমানব মাঝেমাঝে চোখ বন্ধ করে পরিচিত-আধাপরিচিত মানুষের; এমনকি নিজের জীবন নিয়ে ভাবেন। বাড়ির সামনের রাস্তাটিতে যাওয়া-আসা করা লোকজনের কর্মকাণ্ড দেখেন। সঙ্গে থাকে খাতা-কলম। হঠাৎ-হঠাৎ খাতায় কীসব টুকেও রাখেন! সেগুলো নিয়ে রাতে আবার বসেন।
ছেলেটি দাঁড়িয়েই আছে। ঝাঁ-ঝাঁ রোদ পড়েছে। নিজামউদ্দিন দু বার ডাক দিলেন অশ্বমানব বলে। কেউ তাকাল না। এই নাম শুনে ছেলেটির তাকানোর কোনো কারণও নেই। তাছাড়া এখান থেকে আসল নাম ধরে ডাকলেও তার শুনতে পারার কথা নয়। নিজাম সাহেব বসে আছেন রাস্তার পাশের একটি বিল্ডিংয়ের দোতলার বারান্দায়। আর ছেলেটি দাঁড়িয়ে আছে রাস্তার ওপারে একটি খোলা জায়গায়। রাজনকে দিয়ে ছেলেটিকে ঘরে ডেকে আনা যেতে পারে। কিন্তু এ মুহূর্তে তার সেই ইচ্ছা করছে না।
বারান্দা থেকে নিজামউদ্দিন নসিমনের দুধ চায়ের দোকান দেখতে পান। সবসময় কাস্টমার গমগম করে। এই ঠা-ঠা রোদেও মানুষ চা খাওয়ার জন্য দোকানে গিজগিজ করছে। তিনি এই দোকানের ওপর বিরক্ত। নসিমন তার দুগ্ধপোষ্য বাচ্চাটিকে বুকের দুধ খাওয়াতে খাওয়াতে চা বানায়। মাঝেমাঝে বাচ্চা মুখ সরিয়ে নেয়। নগ্নবক্ষ নসিমন একমনে চা বানিয়ে যায়; আশেপাশের এত মানুষের কথা তার খেয়াল থাকে না! পাখির চোখে দেখায় (বার্ড স আই ভিউ) মনে হবে, কাস্টমাররা কেউই সেদিকে তাকান না। কিন্তু একজন কাস্টমারও বক্ষদর্শণ না করে সেখান থেকে ওঠেন না। নিজামউদ্দিন কাস্টমারদের তীক্ষ্মভাবে পর্যবেক্ষণ করেন। একেকজনের ভাবভঙ্গি, তাকানোর কৌশল, হাসিমুখ- এসব দেখে দূর থেকেই তিনি তাদের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য, জীবনাচরণ সম্পর্কে ধারণা করতে চেষ্টা করেন।
অশ্বমানব বিশেষ কারও জন্য অপেক্ষা করছে। অবশ্য নিজাম সাহেব যে কদিন ছেলেটিকে দেখেছেন, সেই কদিন কেউ-ই ছেলেটির কাছে আসেনি। তিনি সাগ্রহে বসে আছেন, আজ হয়তো কেউ আসবে। নিজাম সাহেবের এই অশ্বমানবের নাম নিশান। নিশান একটি প্রাইভেট ইউনিভার্সিটি থেকে বিবিএ-এমবিএ করেছে। এখনো বেকার। দেশের চাকরি বাজারের অবস্থা বুড়িগঙ্গার পানির মতোই জঘন্য। আসলে শুধু জব মার্কেট না, সব মার্কেটের অবস্থাই এক। এমনকি দেশে রাস্তার অবস্থা, মানুষের লাঞ্চ-ডিনার-নাস্তার অবস্থা, জনগণের মাঝে আস্থার অবস্থাও এক।
আজ নিশানের জীবনের একটি বিশেষ দিন। একুশে অক্টোবর। প্রিয় মানুষের সঙ্গে তার প্রথম ঘোরাঘুরির দিন। মেয়েটির নাম রেখা। নিশানের ক্লাসমেট। পাশ করেই একটি ব্যাংকে চাকরি শুরু করে। এখানেই ছিল সেই ব্যাংকের অফিস। মাস দুয়েক আগে ঘটে ভয়াবহ দুর্ঘটনাটি! বিল্ডিংটি ধসে পড়ে। প্রায় সব লাশই উদ্ধার করা সম্ভব হয়েছিল; তবে রেখার লাশ পাওয়া যায়নি। এখানেই তার ভালোবাসার মানুষ ঘুমিয়ে আছে। ঠিক কোন অংশের মাটির নিচে ঘুমিয়ে আছে, তা জানতে পারলে নিশান সেখানটায় হাত বুলিয়ে আদর করে দিত।
নিশানের বন্ধুরা প্রায়ই তাকে খ্যাপাতো। তার কণ্ঠ নাকি স্রষ্টাপ্রদত্ত, একেবারে গানের অযোগ্য! সে রেখাকে তার সুরহীন কড়কড়ে কণ্ঠেই গেয়ে শোনাত,
তুমি চাইয়া দেখ আমার কাছে কী দেই তোমায়,
ফুল চাইলে ঘুম পাড়াবো ফুলের বিছানায়।
নদী চাইলে সাগর দেব চাও যদি তারা,
পুরো আকাশ ঢাইলা দেব ভালোবাসায় ভরা।
প্রাণের প্রিয় মানুষটি কখনো কিছু চায়নি; আর চাইবেও না। কে জানে, নিশান বারবার ছুটে আসুক, হয়তো এটুকুই সে চায়। একারণেই বুঝি নিশান এখানে বারবার ছুটে আসে!
একসময় সকাল গড়িয়ে দুপুর হলো। দুপুর হামাগুড়ি দিলো বিকেলের দিকে। স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে, নিশানের চোখের পানি শুকিয়ে গেছে। প্রকৃতি পানি শুকানোর প্রক্রিয়া না রাখলে মানুষের চোখের পানিতে আরেকটি মহাসাগরের সৃষ্টি হতো। নাম হতো দ্য টিয়ার ওশান ।


মিতু ফেসবুকে স্ট্যাটাস আপডেট করল, মিস ইউ, হাব্বি। মিস ইউ, বরটুস আমার। জিসান ও মিতুর সংসার দু বছরের। মিতু অনেকদিন থেকেই চাকরির চেষ্টা করে যাচ্ছে। এখনো কোনো ব্যবস্থা হয়নি। তাদের এখন পর্যন্ত কোনো বাচ্চা-কাচ্চাও নেই। মিতু বেবি নিতে চায় আরও পরে। জিসান একটি প্রাইভেট কোম্পানির সেলস ম্যানেজার। টাকা আছে কিন্তু অসম্ভব খাটনি। ট্যুরের চাকরি। দেখা যায়, মাসে চব্বিশদিনই তাকে ঢাকার বাইরে থাকতে হয়। মিতুর শ্বশুর-শাশুড়িও থাকেন গ্রামের বাড়িতে। তাই তার সময়গুলো একাকী কাটে।
প্রকাশ না করলেও ফেসবুকে মিতুর ফ্রেন্ডলিস্টের বন্ধুরা তার ওপর ভীষণ খ্যাপা। এত সুখ আমি সইব কেমন করে টাইপের একজন মানুষ ফ্রেন্ডলিস্টে থাকা মানেই নয় নম্বর মহাবিপদ সংকেত! সেই সুখী মানুষের আনন্দ উদযাপনের ফটো-স্ট্যাটাস জলোচ্ছ্বাসের মতো এসে ফেসবুকের ওয়াল ভরিয়ে ফেলে। বন্ধুরা ভেবে পায় না, এই দুঃখদগ্ধ পৃথিবীতে সুখরাশি এত ফুলেফেঁপে ওঠে কীভাবে! বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে সুখ মোটাতাজাকরণ করেও তো এত সুখী হওয়া সম্ভব নয়।
মিতুর মতো দেখতে সুন্দর মেয়েরা তাদের আনন্দ-বেদনা-অস্থিরতা আশেপাশে ছড়িয়ে দিতে পারে। তবে সত্যিই সে সুখে আছে নাকি দুঃখে আছে, সেটি জানার সাধ্য তার শরীর ঘেঁষে থাকা মানুষটিরও নেই। সবসময় উচ্ছ্বসিত মনে হলেও আসলে মিতু ভয়াবহ দুখী। সে যেন তার অনুভূতি প্রকাশক অংশের মুখে ইনভার্টার লাগিয়ে রেখেছে! তাই তার অন্তরের অবস্থা অন্তর্দহ ইঞ্জিনের মতো হলেও ইনভার্টার উল্টে দিচ্ছে বহিঃচিত্র। সবাই তাকে নরম মনের চরম সুখী মানুষ ভাবছে।
আনন্দ করার অনাগ্রহ দিনেদিনে মিতুর মধ্যে আনন্দভীতি এনে দিয়েছে। এক কথায়, চিয়ারোফোবিয়া বলা যেতে পারে। কেমন যেন আলগাভাবে-হালকাভাবে বেঁচে আছে সে! জীবনের সৌন্দর্যগুলো তার হৃদয়ের গহীনে পৌঁছায় না, আগেই পিছলে যায়! অসহ্য অস্থিরতা তাকে তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে। পারদের মতো ছুটোছুটি করছে তার সত্তা। ভালো থাকার অভিনয় তার আর ভালো লাগছে না। যারা মিথ্যার সঙ্গী হয়ে জীবন যাপন করে, তাদের মনে হয় একটু বেশিই ক্যালরি খরচ হয়; তা না হলে মিতুর সারাটা ক্ষণ দুর্বল-দুর্বল লাগে কেন!
মিতু অবশ্য ঘরের মধ্যে নিজের আসল অনুভূতিগুলো লুকায় না। তার এই অতৃপ্তির কথা জিসান ও দেবর নিশান খুব ভালোভাবেই জানে। জিসান অনেকভাবেই স্ত্রীর মন জয়ের চেষ্টা করে। কিন্তু মেয়েরা অতিরিক্ত জেদী হলে তাদের আহত হৃদয়ের ক্ষত কখনোই শুকায় না। মিতু জেদী ও সাহসী মেয়ে। সাহসী মেয়েদের চোখে কখনো পানি দেখা যায় না; অথচ ক্ষণেক্ষণে মাথাচারা দিয়ে ওঠা যন্ত্রণায় হৃদয় প্লাবিত হয়।
জিসান যখনই ভালোবাসার আলিঙ্গনে মিতুকে বাঁধতে চায়, সে তেতিয়ে ওঠে, আমি কিন্তু সুইটহার্ট টাইপের নরম-লাজুক মেয়ে না। এসব আমার ভালো লাগে না। বিরক্তি নিয়ে জিসান ফিরে আসতে বাধ্য হয়। কথায় কথায় তাকে অপমান-ভর্ৎসনাও হজম করতে হয়। হতে পরে, এই ঝাল ঝেড়ে মিতু নিজের আত্মাকে তৃপ্ত করতে চায়! এবার খুলনা যাওয়ার আগে জিসান মিতুকে নিয়ে শর্মা খেতে গেল। জিসানের শর্মা খাওয়া দেখে মিতু কী বিশ্রীভাবেই না বলল, এমন করে খাচ্ছো কেন? দেখে তো মনে হচ্ছে শর্মাটাকে একেবারে রেপ করছ! জিসান শর্মা শেষ করতে পারল না।

আসলে এক অসহ্য অনুভূতি মিতুকে তাড়িয়ে বেড়ায়। তার মনে হয়, সে ঘরের মধ্যে রেপড হয়! এমন নানা চিন্তার জাল বিস্তার লাভ করে তার ব্রেনটাকে জাপটে ধরে বসে আছে। তার ধারণা, সমাজ আয়োজন করে তাকে একজনের লিগ্যাল প্রস্টিটিউট বানিয়েছে। নিজের অনিচ্ছাতেও সেই খদ্দেরকে তার সুখী করতে হবে! জিসানের সাথে তার কাগজে-কলমে বিয়ে হয়েছে ঠিকই; কিন্তু মনের দাম্পত্য কখনোই হয়নি। কই, মিতুর কখনোই তো ভালোবেসে মানুষটিকে কাছে টেনে নিতে ইচ্ছা করেনি। টানহীন-মায়াহীন এই সংসার আর কতটা টেনে নিতে হবে, তার জানা নেই।
অথচ রিয়াজের কথা মনে হলেই তার মধ্যে অদ্ভুত শিহরণ তৈরি হয়। রিয়াজের বুকের মধ্যে মুখ লুকাতে ইচ্ছা করে। সেই অসম্ভব প্রিয় মানুষটির বুকে এখন মাথা রাখে অন্য এক নারী। রিয়াজ কি সেই মেয়ের চোখের দিকে মায়াভরে তাকায়? মায়ামায়া চোখে রিয়াজ মিতুর দিকে তাকালেই সে লজ্জায় মরে যেত! এই নন্দিত নরক তার কাছে ছন্দিত স্বর্গ হয়ে যেত! সে সময় ফ্যামিলির প্রচণ্ড চাপে পড়েই রিয়াজকে ছেড়ে সে জিসানকে বিয়ে করেছে।
মানুষের চোখ কত মেগাপিক্সেল, তা জানা নেই। তবে চোখের জুমিং ক্ষমতা নেই। দূরে চলে যাওয়া মানুষকে একসময় আর দেখতে পাওয়া যায় না। নয়ন তোমারে পায় না দেখিতে, রয়েছ নয়নে নয়নে - ব্যাপারটি এমন হলেও সহ্য করা যায়। কিন্তু ফেসবুকের যুগে এমন সম্ভব নয়। মিতু সবসময় দেখছে, তার প্রাণপ্রিয় মানুষটি অন্য একজনের সঙ্গে সুখের সাগরে সাঁতার কাটছে। কে জানে, সেও হয়তো মিতুর মতো সুখের অভিনয় করে চলেছে!
ফেসবুকে ফেকনেস-এর ধোঁয়া তুলে মিতু নিজের মধ্যে ভালো লাগার বোধ আনতে চায়! বন্ধুদের লাইক-কমেন্ট তার জন্য পেইনকিলার হিসেবে কাজ করে। যখন কেউ বলে সুইট কাপল , তখন সে নিজের মনকে নতুন উদ্যমে বোঝাতে চেষ্টা করে। কিন্তু মন হারামজাদা মনে হয় কোনো লজিকই মানে না! বেয়াড়া মন প্রচণ্ড ঘৃণা আর তার চেয়েও শক্তিশালী ভালোবাসা নিয়ে একজনের নামই সারাক্ষণ জপ করে চলেছে! সময়ের সাথে সাথে নাকি সব ঠিক হয়ে যায়- মিতুর মন কি এই তথ্যটি জানে না? অশ্রু নাকি মানুষের পরম বন্ধু। ব্যাকরণে সে কতবার পড়েছে, কান্নায় শোক মন্দীভূত হয়; এর মতো ভালো মেডিসিন নাকি নাই। কই, একসময় লাফিয়ে-লাফিয়ে চলা প্রাণবন্ত মিতু তো তার বেডরুমটিকে ক্রাইং চেম্বার বানিয়ে ফেলেছে; তবুও তার শোক কমেনি।

৩.
বিল্ডিং ধসে রেখার মৃত্যুর পর থেকে নিশানের মন সারাক্ষণই খারাপ থাকে। ইদানীং মন ভালো করার জন্য সে মাঝেমাঝে গদ্যজীবন যাপন করে। আগে তার জীবন ছিল পদ্যজীবন ! লেখার রুমে বসে দুমদাম মুভি দেখত, ধুমধাম গান শুনত। এগুলো নিউরনে ছন্দ তুলত; তাই জীবনও ছিল ছন্দময়! অবশ্য মাঝেমাঝে বিলাসিতা করে সে ধুম ধরে বসে থাকত। মানুষ বৃষ্টিবিলাস, সমুদ্রবিলাসে যে আনন্দ পায়; নিশান ধুমবিলাস -এ সেই আনন্দ পেত! কারণ ধুমবিলাস দেয় কল্পনার জগতে অবাধ বিচরণের সুযোগ। কল্পনা নিশানকে কাব্যিক আবেশে ডুবিয়ে দিত। লেখার রুমে নিজের ছন্দময় কাব্যিক জীবনযাপনকে নিশান বলত পদ্যজীবন । পদ্যজীবন -এর আবেশে ছোট ছোট কবিতা লিখে সে ফেসবুকে পোস্টও করত।
নিশানের পদ্যজীবন -এর মনে হয় ইতি ঘটেছে। রেখার মৃত্যুর পর তার আর কবিতা লেখা হয়নি। পাঠকের মৃত্যু যেমন হতে পারে; তেমনি কবিরও মৃত্যু হতে পারে! মন ভালো করার জন্য নিশান আজকে পথেপথে ঘুরছে। চলার পথে শোনা যায় কথা , কথা গড়িয়ে গল্প , আশপাশ থেকে ভর করে নানা কাহিনি । পথেপথে ঘোরাকেই সে বলে গদ্যজীবন !
ঈদের ছুটির রেশ এখনো কাটেনি। সব মানুষ ঢাকায় ফিরে আসেনি। তাই রাস্তা বেশ ফাঁকা। সেজন্য গরমেও মেজাজ নরম রাখা সম্ভব হচ্ছে। নিশান সোজা চলে এসেছে ফার্মগেট। তার বড় শখ ফার্মগেটের বিশেষ সিনেমা হলটিতে একদিন সুযোগ বুঝে নিজেকে ঢুকিয়ে দেবে। বাইরে অর্ধনগ্ন পোস্টার থাকলেও সিনেমা হলের ভেতরে নাকি অন্য দুনিয়া! তবে এখন পর্যন্ত বেচারার সাহসে কুলায়নি।
সিনেমা হলের সামনে বসা স্ট্রীট ক্যানভাসারের মূল্যবান বক্তব্য সে মিস করে না। আজকেও আগ্রহভরে শুনছে। স্ট্রীট ক্যানভাসাররা চাপার জোরে বিভিন্ন জিনিস বিক্রি করেন। আজ যিনি আছেন, তিনি এক কথার মানুষ। তার কথার নাকি কোনো নড়চড় হয় না। তিনি বললেন, যার কথা দুই, তার বাপ দুই ! কী অদ্ভুত কথা! তার এই বাণীর মধ্যে কেমন যেন গাণিতিক গন্ধ আছে। কোয়ান্টিটেটিভ বাণী; কোয়ালিটেটিভও! বানী অনুযায়ী, যার কথা তিন, তার বাপও হবে তিন। যারা এক মুখে একেক সময় একেক কথা বলেন, তারা এই বাণী শুনলে নিঃসন্দেহে হকচকিয়ে যাবেন!
নিশান যেখানেই যায়, কীভাবে যেন কোনো না কোনো পরিচিত মানুষের সঙ্গে দেখা হয়ে যায়। তারা লুকানোর চেষ্টা করেন। নিশান সুযোগ দেয় না; ফলে তাদের ভাগ্যে ঘটে দুর্যোগ! নিশান যে বেশি কথা বলে, তা নয়। রাস্তা আটকে দাঁড়ানো পর্যন্তই। তারপর নিষ্ঠুর নীরবতা। কবিতা সরব হয় বলেই হয়তো কবিরা নীরব হয়; তা না হলে তো ভারসাম্য থাকত না। আজকেও পরিচিত কয়েকজনকে সে জাপটে ধরল। তারপর যথারীতি ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থাকল!
ফার্মগেট থেকে নিশান গেল নীলক্ষেত। উদ্দেশ্য, বাণী চিরন্তনী বইটি কিনবে। তাতে ক্যানভাসারের বাণীর মতো কোনো বাণী আছে কিনা খুঁজবে। নীলক্ষেতে বইটি পাওয়া গেল। নিজেকে দরিদ্র কবি হিসেবে পরিচয় দিয়ে বিক্রেতার কাছে সে সর্বাধিক কমিশনও পেল! গদ্যজীবনে তার হাঁটাচলা এলোপাতাড়ি। বই কিনে নিশান কাঁটাবনের দিকে যাত্রা শুরু করল। উদ্দেশ্য, খরগোশ ও কবুতরের দাম জিজ্ঞাসা করবে। জীবন্ত প্রাণীর দাম কীভাবে নির্ধারিত হয়, লজিকটা বোঝা দরকার। পথে সে চায়ের মধ্যে কেক ডুবিয়ে খেল। এক পিস কেক নিল সাত টাকা আর এক কাপ চা ছয় টাকা। তেরো টাকায় তেরো পার্বণের আনন্দ! মনে আনন্দ নিয়ে নিশান গন্তব্যস্থলে পৌঁছল। একজোড়া খরগোশ পাঁচশ টাকা আর একজোড়া সিরাজী কবুতর সাত হাজার টাকা! দাম কীভাবে নির্ধারিত হয়, সেই লজিক সে ধরতে পারল না। মনে মনে আওড়াল, লজিক ব্যাপারটাই টক!
রাস্তা ফাঁকা, তাই হাঁটতে চমৎকার লাগছে। নিশান হেঁটেই চলে গেল কারওয়ান বাজার। প্রিয় পানীয় কিউ-কিউ খাওয়া দরকার। কিন্তু দেখল, বসুন্ধরা সিটি শপিং মলের ফুড কোর্টও ফাঁকা; মানে বন্ধ। পানীয় না খেয়ে যে বাসায় ফিরবে, তারও উপায় নেই। কারণ ততক্ষণে চোখে পড়েছে আখের রস। না চেখে যাওয়া ইমপসিবল। নিশান লেবুর রস আর মশলা মিশ্রিত আখের রস খেল। অপূর্ব! আখের রস কিউ-কিউ এর বিরহ ভুলিয়ে দিল। সুপেয় পানীয়ের জন্য বিক্রেতার গলায় একটি মেডেল ঝুলিয়ে দিতে ইচ্ছা হলো তার।
নিশান কারওয়ান বাজারে ফুটপাত ধরে হাঁটছে। হঠাৎ কোন্ আইসক্রিম দেখে খেতে ইচ্ছা হলো। নিশান যে খাই-খাই স্বভাবের বা ভোজনরসিক, তা-ও না। তবে আইটেমরসিক । নতুন আইটেম দেখে দাঁড়াল। জিজ্ঞেস করল, কোন কোন ফ্লেভারের আইসক্রিম আছে? আইসক্রিমওয়ালা মামা গম্ভীরভঙ্গিতে জানালেন, ইশটুবিড়ি, ম্যানগু ! সে দুই ফ্লেভারের দুই স্কুপ ইনসাফমতো দিতে বলল। ইনসাফের কথা শুনে মামা সাফ বললেন, আমি ঠকার ব্যবসা করি না । বেশ ডিপ্লোম্যাটিক উক্তি! তিনি ঠকেন না, নাকি ক্রেতা ঠকেন না; উক্তিতে বিষয়টি ক্লিয়ার না।
অবশেষে বাসে চেপে নিশান বাসার উদ্দেশে রওনা দিয়েছে। আকাশ কালো হয়ে গেছে। চোখ বন্ধ করে সে নতুন কবিতার ছন্দ খোঁজার চেষ্টা করছে। ধীরেধীরে বাসের মধ্যে নিজেকে সে এক আবেশে আটকে ফেলল। নিশান দুঃখকে ভুলে থাকার জন্য এভাবেই এলোপাতাড়ি অনুষঙ্গের সঙ্গে নিজেকে জড়ায়, সেগুলো থেকে জোর করে আনন্দ শুঁষে নেওয়ার চেষ্টা করে। নানাভাবে নিজেকে ব্যস্ত রাখতে চায়; হাসিখুশি রাখতে চায়। এটি মানুষের রহস্যময় মস্তিষ্কের একটি বিচিত্র প্রসেসের অংশ। মস্তিষ্ক তার সত্তাটিকে ব্যতিব্যস্ত রাখার মাধ্যমে ভয়াবহ কষ্টের স্মৃতি মনে করার সুযোগ দেয় না; সেগুলো একপাশে চাপা দিয়ে রাখে। সৃষ্টির মঙ্গলের জন্যই এই প্রক্রিয়া।
একটু পর কন্ডাক্টরের চিৎকারে নিশান সম্বিৎ ফিরে পেল। পঙ্গু হাসপাতালের কাছাকাছি আসতেই কন্ডাক্টর চেঁচিয়ে উঠেছে, অ্যাই, শিশুমেলা, ভাঙাচোরা, পঙ্গু নামেন ! নিশান শ্যামলীর ওভারব্রিজের কাছে নামল। সে থাকে আদাবরে; ভাইয়া-ভাবীর সঙ্গে।