কথায় বলে, ‘সুখে থাকতে ভূতে কিলায়'৷ সাজসরঞ্জাম নিয়ে অথবা সে সব ছাড়াই যারা পাথর বেয়ে উপরে ওঠায় ওস্তাদ, তাদের দেখলে এমন মনে হাতে পারে বৈকি৷ ইউরোপে প্রায় ২ লক্ষ মানুষ এই কঠিন খেলায় মেতেছেন৷
জার্মানির দক্ষিণে ‘ফ্র্যাংকোনিয়ান সুইজারল্যান্ড' বলে পরিচিত এলাকায় এক টিলা৷ আলেক্সান্ডার মেগোস ও তাঁর বন্ধুরা এখানে নিয়মিত অনুশীলন করেন৷ সেই ৫ বছর বয়স থেকেই পাহাড় বেয়ে উঠছেন আলেক্সান্ডার৷ এখন তাঁর বয়স ২১৷ তরুণ ইউরোপীয় চ্যাম্পিয়ন হিসেবে তাঁকে বিশ্বের সেরাদের একজন বলে গণ্য করা হয়৷ নতুন রুটের খোঁজে তিনি সারা পৃথিবী চষে বেড়ান৷ তাঁর মতে, রক ক্লাইম্বিং মোটেই ঝুঁকিপূর্ণ নয়৷ আলেক্সান্ডার বলেন, ‘‘পাথরের লাগানো আংটা অত্যন্ত নিরাপদ৷ কোনো সমস্যা ছাড়াই ঝুলে পড়া যায়৷ কয়েক টন ওজন নেবার ক্ষমতা রয়েছে৷ প্রথম দর্শনে ক্লাইম্বিং বিপজ্জনক মনে হতে পারে৷ ভালো করে দেখলে বোঝা যায়, কাজটা মোটেই বিপজ্জনক নয়৷''
বহুকাল হলো, ক্লাইম্বিং বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে৷ গত ১০ বছরে রক ক্লাইম্বারদের সংখ্যা প্রায় ১০ গুণ বেড়ে গেছে৷ কিন্তু ক্লাইম্বিং এত আকর্ষণীয় কেন?
দুই মার্কিন ফ্রি-ক্লাইম্বার পর্বতারোহণের ইতিহাস গড়লেন
অনেকেই ভেবেছিলেন এটা করা সম্ভব নয়: টমি ক্যাল্ডওয়েল এবং কেভিন ইয়র্গসন হলেন প্রথম পর্বতারোহী, যারা জোসেমিটি পার্কের এল কাপিতান পাহাড়গুলির ‘ডন ওয়াল’ বা ‘প্রত্যুষের প্রাচীর’ নামধারী খাড়া পাথরের দেয়ালটিতে চড়েছেন৷ এই ‘রক ক্লাইম্ব’-টি বিশ্বের সবচেয়ে কঠিন বলে খ্যাত৷
একজন বললেন, ‘‘শারীরিক ক্ষমতার অভিব্যক্তি, ক্ষমতার সীমা পরখ করা, নিজেকে ভালোভাবে চেনা – সব মিলিয়ে দারুণ ব্যাপার৷'' অন্য একজনের মতে,‘‘বৈচিত্র্যের অভাব নেই৷ প্রতিবারই আলাদা রুট, আলাদা অভিজ্ঞতা৷ চ্যালেঞ্জে ভরা যাত্রাপথ৷ পদে পদে নতুনত্বের স্বাদ৷''
ক্লাইম্বিং সম্পর্কে আগ্রহ বেড়ে চলায় জার্মানির অ্যালপাইন ক্লাবের পোয়াবারো৷ ২০১৩ সালের জুলাই থেকে সদস্যসংখ্যা ১০ লক্ষের গণ্ডি পেরিয়ে গেছে৷ বিশ্বের সবচেয়ে বড় পাহাড় চড়ার সংগঠন হয়ে উঠেছে এটি৷ জার্মান অ্যালপাইন ক্লাবের গিডো ক্যোস্টারমায়ার বলেন, ‘‘গত দুই দশক ধরে ধীরে ধীরে এই প্রবণতা বাড়ছে৷ গত কয়েক বছরে তার গতি আচমকা বেড়ে গেছে৷ ক্লাইম্বিং সম্পর্কে জনমানসে আগ্রহ বেড়ে গেছে৷''
আসলে আউটডোর স্পোর্টস ক্ষেত্রটির যে বাড়-বাড়ন্ত, রক ক্লাইম্বিং-ও সেই প্রবণতার অংশ৷ আর্থিক সংকটও এই ক্ষেত্রকে প্রায় ছুঁতে পারে নি৷ খেলাধুলার সাজসরঞ্জাম নির্মাতারা প্রতি বছর মুনাফা করছে৷ পাহাড় চড়ার দামি সরঞ্জাম বিক্রিও তার অন্যতম কারণ৷ ক্রেতাদের সিংহভাগই শহরবাসী৷ ক্লাইম্বিং-এর জন্য আজ আর পাহাড়ে ছুটতে হয় না, অনেক পুরনো কারখানাও তার উপযুক্ত করে গড়ে তোলা হয়েছে৷
আছে রক ক্লাইম্বিং হলও৷ ফলে বাইরের আবহাওয়ার উপর নির্ভর করতে হয় না৷ জার্মানিতে এমন প্রায় ৪০০ হল রয়েছে৷ গত কয়েক বছরেই তাদের মধ্যে বেশিরভাগ তৈরি হয়েছে৷ ক্লাইম্বিং চ্যাম্পিয়ন ইয়াকব নিমান বলেন, ‘‘অনেকেই মনে হয় দৈনন্দিন জীবনে এমন পরিস্থিতি খোঁজেন, যাতে নিজের সীমা যাচাই করে নেওয়া যায়৷ ক্লাইম্বিং তার জন্য অত্যন্ত উপযুক্ত৷ হাতেনাতে ফলাফল পাওয়া যায়৷ হয় আমি উপরে উঠতে পারলাম, কিংবা পারলাম না৷''
ক্লাইম্বিং পার্কের কদর বাড়ছে
ক্লাইবিং মানেই উচ্চতার সঙ্গে খেলা৷ কখনো দড়ির তৈরি সিড়ি ধরে ওঠানামা করতে হবে, কখনো দড়ি ধরে ঝুলতে হবে, আবার কখনো সহায়তা করতে হবে সঙ্গীকে৷ ভূমি থেকে ৬ মিটার থেকে বিশ মিটার অবধি উপরে চলাফেরা খুব স্বাভাবিক ক্লাইম্বিং কোর্সে৷ তাই উচ্চতা নিয়ে যারা ভীত তাদের এদিকে না আগালেই ভালো৷
ক্লাইম্বিং-এরই কিছুটা হেরফের ঘটিয়ে শুরু হয়েছে ‘বোল্ডারিং'৷ এক্ষেত্রে উচ্চতা মূল বিষয় নয়, দড়ি বা বেল্ট ছাড়াই পাথর বেয়ে শীর্ষে উঠতে হয়৷ অনভিজ্ঞরাও দামি সরঞ্জাম ছাড়া সেই চেষ্টা করতে পারেন৷ ইয়াকব নিমান বলেন, ‘‘ক্লাইম্বিং-এর সঙ্গে বোল্ডারিং-এর তফাত হলো, পাথরের বিশাল আকার-আয়তন সামলাতে হয়৷ ছোট ছোট ধাপে তা আঁকড়ে ধরাই মূল চ্যালেঞ্জ৷ হাত আর পা কাজে লাগিয়ে যাত্রা শুরু করতে হয়৷ তারপর পরের ধাপগুলি আঁকড়ে ধরে উঠতে হয়৷''
আগে ক্লাইম্বাররা প্রকৃতির টানেই বেরিয়ে পড়তেন৷ নিসর্গ উপভোগ করাও তাঁদের কাছে ক্লাইম্বিং-এর মতোই জরুরি ছিল৷ আবহাওয়া খারাপ থাকলেই তাঁরা হলের মধ্যে অনুশীলন করতেন৷ আর আজ তাঁরা ঠিক এর বিপরীতটাই করেন৷ জার্মান টিমের ট্রেনার গিডো ক্যোস্টারমায়ার বলেন, ‘‘অনুশীলনের এই হল এখন ক্রীড়াকেন্দ্র হয়ে উঠেছে৷ অন্যরা এখানে ক্লাইম্বিং করতে আসে৷ আর আজ বোল্ডারিং-এর হল নতুন প্রবণতা হয়ে উঠেছে৷ সেটি আলাদা এক স্পোর্টসের শাখা হয়ে উঠছে৷ আমি তাদের ‘ফিটনেস-ক্লাইম্বার' বলি৷''
প্রকৃতির কোলে হোক অথবা হলের মধ্যে – এটি এমন এক ক্রীড়া হয়ে উঠেছে, যার মাধ্যমে প্রত্যেকে তার ক্ষমতার সীমা পরখ করে দেখতে পারে৷ ইউরোপের প্রায় ২০ লক্ষ মানুষ ক্লাইম্বিং করে চলেছেন৷