মানুষের হামলা বা তাড়া খেয়ে দুর্ঘটনায় মৃত্যুর পরও কক্সবাজার বনাঞ্চলে হাতির সংখ্যা বাড়ছে। গত কয়েক মাসে নতুন শাবকসহ কয়েকটি হাতির দলকে কক্সবাজারের বিভিন্ন বনাঞ্চলে বিচরণ করতে দেখা গেছে। তবে বনাঞ্চল কমে যাওয়ায় মহাবিপন্ন প্রাণীর তালিকায় থাকা এ প্রাণীটি বর্তমানে খাদ্য সংকটে পড়ে বনাঞ্চলের পার্শ্ববর্তী লোকালয়ে নিয়মিত হানা দিচ্ছে। এতে হাতির হামলায় মারা যাচ্ছে অনেক মানুষ। গভীর বনাঞ্চলে হাতির জন্য পর্যাপ্ত খাদ্যভাণ্ডার সৃষ্টি করে কয়েকটি অভয়ারণ্য গড়ে তোলা হলে একদিকে বনাঞ্চল সমৃদ্ধ হবে, অন্যদিকে পর্যটন শিল্পের উন্নতি হবে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, সাম্প্রতিককালে কক্সবাজার বনাঞ্চলে হাতির সংখ্যা ও বিচরণ বেড়েছে। হিমছড়ি ও রামুতে বন্য হাতি নতুন শাবক জন্ম দিয়েছে। শাবকসহ হাতির দল বনাঞ্চলের এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্ত পর্যন্ত ঘুরে বেড়াচ্ছে। তবে বনাঞ্চলে বসতি ও নানা স্থাপনা নির্মাণের কারণে বনাঞ্চল কমে যাওয়ায় সেখানে হাতির খাদ্য সংকট তৈরি হয়েছে। এ কারণে বেড়েছে লোকালয়ে হানা দেওয়ার ঘটনাও। গত কয়েক মাসে বনাঞ্চলে ও এর পার্শ্ববর্তী লোকালয়ে হানা দিয়ে বেশ কয়েকজন মানুষকে হত্যা করেছে বন্য হাতির দল। সে সাথে মানুষের হামলায় বা তাড়া খেয়ে হাতি মৃত্যুর হারও বাড়ছে। গতমাসে কক্সবাজার দক্ষিণ বনবিভাগের দরিয়ানগর বনাঞ্চলে মানুষের তাড়া খেয়ে পাহাড় থেকে পড়ে মারা যায় একটি ১০/১১ বছর বয়সী শাবক হাতি। উক্ত এলাকায় প্রায়ই বন্যহাতির দল কাঁঠাল, কলাগাছ, নারিকেল গাছ ও বাঁশ খেতে আসে বলে জানায় স্থানীয়রা।
স্থানীয় বাসিন্দা মো. ইব্রাহিম (৭০) জানান- তিনি এ বছর বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন আকারের হাতির দল দেখতে পেয়েছেন। এরমধ্যে একটি দলে রয়েছে শাবকসহ ১৩টি হাতি, অন্য একটিতে শাবকসহ ৭টি হাতি এবং আরেকটি ৩টি হাতি। এ ছাড়া দল ছুট হাতিও দেখা যায় মাঝে মধ্যে। গত চার দিন আগে রামুর থোয়াইংকাটা ও দারিয়ারদীঘি এলাকায় শাবকসহ ৩টি হাতির একটি দল দেখতে পেয়েছেন বলে জানান রামুর বাসিন্দা মো. ইউনুছ।
কক্সবাজার বনাঞ্চলে হাতি বৃদ্ধির কথা স্বীকার করেছেন দক্ষিণ বিভাগের বিভাগীয় কর্মকর্তা মো. আলী কবির ও উত্তর বিভাগের বিভাগীয় কর্মকর্তা মো. ইউসুফ। একই কথা জানান, পরিবেশবাদী আবু মোর্শেদ চৌধুরী খোকা। তবে তার মতে, বনাঞ্চল কমে যাওয়ায় সেখানে হাতির খাদ্য সংকট তৈরি হয়েছে। ফলে প্রায়ই লোকালয়ে হানা দিচ্ছে হাতির দল। এছাড়া হাতি চলাচলের পথও রুদ্ধ করে দেয়া হচ্ছে। এরফলে হাতির বিচরণ ও খাদ্য ভান্ডার সীমিত হয়ে পড়ছে।
ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর কনজারভেশন অব নেচার (আইইউসিএন) এর জরিপেও কক্সবাজারসহ দেশের বনাঞ্চলে হাতি বৃদ্ধির কথা বলা হয়েছে। ২০১৩ সাল থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত চালানো উক্ত জরিপে দেশে বন্য হাতির সংখ্যা ২৬৮টি বলে উল্লেখ করা হয়। যা আগের গণনার চেয়ে ১শ’টি বেশী। এসব হাতির মধ্যে ২৯টি বাচ্চা হাতি এবং ৬৭টি বয়স্ক পুরুষ হাতি রয়েছে। তবে পুরুষের প্রায় তিনগুণ আছে মহিলা হাতি, যার সংখ্যা ১৭২টি। জরিপে বলা হয়েছে, বনাঞ্চলে এরই মধ্যে বন্ধ হয়ে গেছে হাতির চলাচলের ১১টি পথ।
জরিপে আরো বলা হয়, দেশের ৭টি বন এলাকায় বাস করে বন্য হাতি। এরমধ্যে ৪টি বনে অনিয়মিতভাবে আসে অভিবাসী হাতিও। বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে আন্তঃদেশীয় যে ৫৭টি পথ দিয়ে হাতি চলাচল করতো তার মধ্যে ১১টি পথ বন্ধ হয়ে গেছে। জরিপের রিপোর্টে আরও জানানো হয়, ২৬৮টি বন্য হাতি ছাড়াও ৯৩টি অভিবাসী হাতি এবং ৯৬টি পোষা হাতির বাস এখন বাংলাদেশে।
আইসিইউএনের দেওয়া তথ্যানুযায়ী বনবিভাগের চট্টগ্রামের দক্ষিণ অঞ্চলে হাতি আছে ৩০ থেকে ৩৫টি। কক্সবাজার উত্তর ও দক্ষিণ বিভাগ মিলিয়ে আছে ৮২ থেকে ৯৩টি। বান্দরবানে আছে ১২ থেকে ১৫টি এবং লামা বিভাগে আছে ৩৫ থেকে ৪০টি হাতি। এ ছাড়া কক্সবাজার উত্তর বিভাগে আরও ৭ থেকে ৯টি এবং দক্ষিণ বিভাগে ৩০ থেকে ৩৫টি হাতি রয়েছে। তবে গত এক দশকের তুলনায় দেশে হাতির সংখ্যা কিছুটা বাড়লেও এখনও মহাবিপন্ন প্রাণীর তালিকায় রয়েছে বাংলাদেশের হাতি। আইইউসিএনের গবেষণা প্রতিবেদনে বাংলাদেশে বিপন্ন হওয়ার ৯টি কারণও উল্লেখ করা হয়েছে। এর মধ্যে অন্যতম বনাঞ্চল নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়া, খাদ্য সংকট, চলাচলের পথ রুদ্ধ হয়ে যাওয়া, যত্রতত্র জনবসতি গড়ে ওঠা এবং চোরাশিকারিদের নিষ্ঠুরতা। ২০০১ থেকে ২০১৫ সালের ৩০ জুলাই পর্যন্ত শুধু বান্দরবান ও কক্সবাজার জেলার ৬টি উপজেলার সংরক্ষিত বনাঞ্চলে দাঁত ও হাড়গোড়ের জন্য ১৫২টি হাতি হত্যা করা হয়।
পরিবেশ বিজ্ঞানীদের মতে, পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় হাতি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। তা ছাড়া হাতিকে বলা হয় আমব্রেলা স্পেসিস। কারণ, একটি হাতি বনে ছাতার মতো কাজ করে। অর্থাৎ হাতি যদি বেঁচে থাকে, তাহলে বনও টিকে থাকবে। আর একটি বনের টিকে থাকা মানে হাজারো জীববৈচিত্র্যের জীবন বেঁচে যাওয়া, পরিবেশ-প্রকৃতির ভারসাম্য ঠিক থাকা। গন্ডার, বারশিঙ্গা, বুনো মহিষ, গোলাপি মাথার পাতিহাঁস প্রভৃতি প্রাণী দেশ থেকে বিলুপ্ত হয়ে গেছে। হাতি যেন সে পথ না ধরে, সে জন্য বনাঞ্চলে হাতির জন্য পর্যাপ্ত খাদ্য ভান্ডার ও বিচরণক্ষেত্র নিশ্চিত করা জরুরি। তাহলে এক দিকে বন রক্ষা হবে, অন্যদিকে হাতি দেখতে আসা মানুষের ভীড়ে এখানকার পর্যটন শিল্পেরও উন্নতি হবে।