(বুকের ভিতর ধুকধুক-ধুকধুক) আস্তে করে দরজাটা খুলে দরজার ফাঁক দিয়ে নিজের মাথাটা গলিয়ে বললাম, আসতে পারি স্যার?
স্যার বললো, আসো।
ভিতরে ঢুকেছিলাম, তখনি উনি বলে উঠলো,আপনি মামুনুর রশিদ, বুয়েট থেকে। রশিদ নাকি রাশিদ?
আমি স্যারকে থামিয়ে দিয়ে বললাম, আসসালামু আলাইকুম স্যার। (আগে থেকেই ভেবে রেখেছিলো ভিতরে ঢুকেই সালাম দিবো, তাই নিজেকে সামলাতে পারেনি এই বান্দা)
বললাম, জি স্যার, রাশিদ।
স্যার বললো, টেক ইউর সিট।
বসতে বলেছে এই খুশিতে চটপট বসে পড়লাম, কিন্তু বসার সময় জুতার সাথে চেয়ারের পায়ের সংঘর্ষে দড়াম করে শব্দ হলো।
এক, দুই, তিন, চার, পাঁচ… পাঁচ নম্বরে সহকারী প্রকৌশলী, নিজের সাবজেক্টের উপর এতো আক্রোশ কেনো?
বান্দা জানালো যে, না স্যার আক্রোশ নেই, কিন্তু জেনারেলের কিছু ক্যাডার বেশি ভালো লাগে। বিশেষ করে পুলিশ ক্যাডার।
স্যার বললো, তা পুলিশ ক্যাডার এতো ভালো লাগার কারণ কি?
আমি বিড়ালের মত কিছুক্ষণ মিউমিউ করলাম। অনেক ব্যতিক্রমী কিছু বলবো বাসা থেকে ভেবে গিয়েছিলাম। কিন্তু মাথা কাজ করছিলো না, শেষমেশ, চ্যালেঞ্জ, এডভেঞ্চার, মুভি, এসব বালছাল গতাণুগতিক কথা বললাম।
চেয়ারম্যান সাহেব বললেন, আপনি তো এএসপি হিসেবে জয়েন করবেন, বলেন দেখি আপনার সমমানের র্যাঙ্ক ভারতে কি? একথা বলে স্যার আমার দিকে না তাকিয়ে ডানপাশের এক্সটারনালের দিকে তাকালেন। মনে হচ্ছিলো, যেনো প্রশ্নটা ওনাকেই করেছেন। আমিও এক্সটারনালের দিকে তাকালাম, দেখি উনি ভরকে গেছেন, চেহারায় স্পষ্ট দেখা গেলো, উনিও এটা জানেন না।
প্রশ্ন শুনে, মনে মনে ভাবলাম, আরেহ এ তো সোজা প্রশ্ন। ভারতীয় চ্যানেল খুললেই পুলিশ অফিসার দেখা যায়। কিন্তু মাথার মধ্যে এ-সি-পি-আই-সি-এস-আই-পি-এস এসব অক্ষর ঘুরপাক খেতে শুরু করলো, বলে দিলাম সরি স্যার।
স্যার বললেন, এই না আপনি বললেন মুভি দেখেন, তাহলে বলতে পারলেন না কেনো? জলসা টিভিতে দেখেন না, একটি সুন্দর করে মেয়ে পুলিশ অফিসার, সারাদিন দেখায়।
আমি বললাম, স্যার আমি জলসা দেখি না।
স্যার বললেন, আচ্ছা মিস্টার মামুনুর রাশিদ, প্লিজ ইন্ট্রডিউস ইউরসেল্ফ্।
প্রশ্ন কমন পড়েছে দেখে উল্লাসিত হয়ে বললাম, থ্যাঙ্ক ইউ স্যার, দিস ইজ মোঃ মামুনুর রাশিদ, মাই প্যারেন্টস্ আর ব্লা ব্লা ব্লা… আই কমপ্লিটেড মাই গ্রাজুয়েশন ইন সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং ফ্রম বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অফ ইঞ্জিনিয়ারিং এন্ড টেকনোলজি, আই পাস্ড এইসএসসি…
আমাকে থামিয়ে দিয়ে বললেন, আপনি বুয়েট থেকে ইঞ্জিনিয়ারিং পাসের সব সার্টিফিকেট দিয়ে এখন বলতেছেন কমপ্লিটেড? বলেন আই পাস্ড…
আবার বললাম, আই পাস্ড ব্লা ব্লা ব্লা…
ভালোই বলতেছিলাম, এসএসসি পাস করার আগেই আমাকে থামিয়ে দিলেন। ঠিক করে রেখেছিলাম বলবো, আমিই আমার স্কুলের প্রথম এ প্লাস পাওয়া ছাত্র, বলে সেই একটা ভাব নিবো, কিন্তু হলো না।
এক এক্সটারনালের হাতে শপে দিলেন আমাকে।
সেই এক্সটারনালকে দেখে খুবই নার্ভাস মনে হচ্ছিলো। তিনি ভয়ে ভয়ে মিষ্টি করে হেসে আমাকে বললেন, তোমার ফার্স্ট চয়েসতো পুলিশ, তা তোমাকে পুলিশ থেকে প্রশ্ন করবো নাকি অন্য কোনো টপিক থেকে?
আমিও ঈষৎ হেসে বললাম স্যার, আপনার ইচ্ছে, যেকোনো টপিক থেকে প্রশ্ন করতে পারেন। (এমন একটা ভাব আমার, সবজান্তা শমশের আলি।)
স্যার বললেন, আচ্ছা আন্তর্জাতিক অপরাধ জিনিসটা কি? কিছু আন্তর্জাতিক অপরাধের নাম বলো দেখি।
আমি বললাম, মানব পাচার।
উনি বললেন না না, এসব না।
আমি বললাম, যুদ্ধাপরাধ।
উনি খুশি হয়ে গেলেন, বললেন, হ্যাঁ হ্যাঁ। আর কি কি আছে?
আমি ম্যা ম্যা করলাম।
উনি বললেন আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনালের নাম শুনেছো?
আমি জানালাম জি স্যার, শুনেছি।
স্যার বললেন, এটার পুরো নাম কি?
আমি বললাম, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল- ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইম্স্ ট্রাইব্যুনাল।
এটা কি আমাদের দেশীয় নাকি, ইন্টারন্যাশনাল?
কনফিউশন নিয়েই জানালাম, আমাদের দেশীয়।
চেয়ারম্যান স্যার আমাকে আবার ছিনতাই করে নিয়ে, বললেন, পিআরবি নাম শুনেছো? কি কাজে লাগে এটি?
প্রশ্ন কমন, তাই গরগর করে উগলে দিলাম।
এইবার আরেক এক্সটারনাল আমাকে অ্যাটাক করলো, আচ্ছা এই যে তুমি সরকারী কর্ম কমিশনে ভাইভা দিতে এসেছো। এর কথা সংবিধানের কোথায় আছে?
এই প্রশ্নটিও কমন পড়েছে, তবু ভয়ে ভয়ে উত্তর করলাম।
এবার উনি বললেন, বলো দেখি, ১৪১ক ধারায় কি আছে?
সংবিধান ভালো করে পড়িনি, তবু এই ধারাটি পরিচিত, কিন্তু ঐ মুহূর্তে মনে পড়ছিলো না। উত্তর করতে না পারায়, এক্সটারনাল সাহেব মর্মাহত হলেন।
বললেন, এইটা জরুরী অবস্থা ঘোষণার ধারা। এইটাতো ভেরি কমন, এইটা না পারলে চলে?
আসলেই তো, এইটা না পারলে চলে? আমার ভিতরে যে জরুরী অবস্থা চলছে, সেইটা কোন ধারায়, তাও তো জানিনা।
চেয়ারম্যান সাহেব সেই প্রথম থেকেই নতুন বরের মত একহাত দিয়ে মুখ ঢেকে রেখেছেন, জানিনা উনি কি আমাকে দেখে লজ্জা পেয়েছেন নাকি ওনার মুখে গন্ধ! কি যেনো মিনমিন করে বললেন। শুনতেই পেলাম না।
বললাম সরি স্যার, উনি মনে করলেন আমি মনে হয় এন্সার জানি না।
এইবার চেয়ারম্যান সাহেব তার বডিটাকে ফিক্সড রেখে ঘড়ির কাটার দিকে পুরো ১৮০ ডিগ্রী কোণে ঘুরে পেছনে দেয়ালে সাঁটানো বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতির দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করে বললেন, এই ছবি এখানে লাগানো হয়েছে কেনো?
আমি বললাম সংবিধানে বলা আছে।
বললো, সংবিধানের কোথায় আছে, কোন ধারায়, কোন তফসীলে?
আমি জানতাম ৪ক অনুচ্ছেদে, কিন্তু উনি তফসীল বলার পর ঘাবড়ে গেলাম। তবু বললাম ৪ক অনুচ্ছেদ আছে জাতির জনকের প্রতিকৃতি ব্লা ব্লা ব্লা…
উনি বললেন, সংবিধানে কি আছে, জাতির জনক, নাকি জাতির পিতা?
আমি বললাম, জাতির জনক।
উনি বললেন আর ইউ শিউর? আজকে এখান থেকে বাসায় গিয়ে এটা দেখে নিবা। এখন তুমি আসতে পারো…
উঠে চলে আসতেছিলাম দরজার কাছাকাছি চলে এসেছি, পেছনে শুনলাম, চেয়ারম্যান স্যার অন্য দুইজনকে বলতেছে, একটা ছেলে বুয়েট থেকে পাশ করেছে, অথচ জানে না, জাতির পিতা নাকি জাতির জনক।
দরজা খুলে বের হবো, তখন মনে পড়লো, আগের জন বের হবার সময় খুব সাবধানে দরজা লাগিয়েছে, একটুও শব্দ হয়নি। আমিও খুব সাবধানে দরজা লাগালাম, কিন্তু হায়! দড়াম করে শব্দ হলো।