সাধারণ মধ্যবিত্ত ঘরের তরুণী, যে নিজের জীবন নিয়ে অনেক স্বপ্ন দেখে। কিন্তু স্বপ্নের পথে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে তার ঈশ্বরপ্রদত্ত গায়ের রঙ। এ নিয়ে সে খুবই হতাশ। অবশেষে কোনো এক বান্ধবীর পরামর্শে একটি ‘জাদুকরি’ রঙ ফর্সাকারী ক্রিমের খোঁজ পেলো। সেই ক্রিম ব্যবহার করে রাতারাতি পাল্টে গেলো তরুণীর ভাগ্য। রাস্তাঘাটের ছেলেরা অবাক হয়ে তার দিকে তাকাতে লাগলো যারা এতদিন তাকে অবজ্ঞা করতো। একদিন তার স্বপ্নের রাজপুত্র ময়ুরপংখি নাও ভিরালো তার ঘাটে। তার পর শুধু আনন্দের গল্প! কালো মেয়েটের ভাগ্য পরিবর্তনের পুরো কৃতিত্ব রঙ ফর্সাকারী ক্রিমের!! সত্যি হোক কিংবা ভ্রান্তি, মানুষ এখন ফরসা ত্বকে মোহগ্রস্ত। ছেলে কিংবা মেয়ের স্বপ্নের রানী বা রাজা কোন কালো ত্বকের কেউ নয়। একটা ছেলের রঙিন চোখ খুঁজে ফিরে একটা ফর্সা সুন্দরী ললনা। তা হোক জীবন সঙ্গীনি কিংবা বন্ধুত্ব করার জন্য। তেমনি একটা মেয়েও কখনোই কল্পনা করেনা যে একটা কালো ত্বকের ছেলে তার জীবন সঙ্গী বা বন্ধু হবে। ছেলে মেয়ে কেউই চায়না কালো ত্বকের কারো সাথে জীবনে জড়াতে। ছেলে কিংবা মেয়ে সবার অবচেতন মনের গহীনে লালন করে একটি সুন্দর ত্বকের বিপরীর লিঙ্গের মানুষ। এটা শুধু বাংলাদেশ কিংবা ভারতে নয়, পৃথিবীর অনেক দেশেই। যদিও ভাগ্যের লিখন না যায় খন্ডন। আর এ সুযোগ নিতে ভুল করেননি ব্যবসায়ীরা। তারা বিভিন্ন কৌশলে ত্বক ফর্সা করার প্রলোভন দেখিয়ে উপস্থান করছে নিত্য নতুন উপকরণ। হাজির করছে নানান নামের রং ফর্সা করা ক্রিমের পসরা। দেশী বিদেশী কসমেটিক কোম্পানিগুলো নিয়ে এল রঙ ফরসাকারী ক্রিম। কয়েক দশক ধরে ধীরে ধীরে এর বাজার বাড়ল। একসময় সেলিব্রিটিরা এসব পণ্যের প্রচারে নামলেন, বিক্রি উঠল তুঙ্গে। ভারতের গবেষণা সংস্থা গবেষণা সংস্থা ACNielsen এর মতে শুধু ইন্ডিয়াতেই ২০১০ সালে এই বাজারের আর্থিক মূল্যমান ছিল ৪৩২ মিলিয়ন ডলার এবং প্রতি বছর ১৮% প্রবৃদ্ধি নিয়ে অগ্রসর হচ্ছে। গত বছর দেশটিতে ফেয়ারনেস ক্রিম ব্যবহার করা হয়েছে ২৩৩ টন।
সম্ভবত ব্রিটিশরা উপমহাদেশে শাসন শুরু করবার পর থেকেই এই ধারণা জন্মাতে শুরু করে যে, গায়ের রং ফর্সা মানেই সুন্দর। অবশ্য এরও আগে বর্ণপ্রথার সুবাদে এই ধারণা জন্মায় যে ‘ব্রাহ্মণরা শুদ্ধ বিধায় সাদা এবং দলিত তথা নিম্ন বর্ণের লোকজন অশুদ্ধ বিধায় কালো’। ধীরে ধীরে ফর্সা হওয়ার ধারণা এত ব্যাপক বিস্তৃতি লাভ করে যে এশিয়া মহাদেশ কিংবা আরেকটু স্পষ্ট করে বললে ভারতীয় উপমহাদেশ ফেয়ারনেস ক্রিম কোম্পানিগুলোর সবচাইতে বড় বাজারে পরিণত হয়েছে। উপমহাদেশের নামজাদা সব অভিনেতা-অভিনেত্রীই ফেয়ারনেস ক্রিম কোম্পানিগুলোর মডেল হয়েছেন,যার ফলে এইসব ফেয়ারনেস ক্রিম নারীসমাজের মধ্যে তুমুল জনপ্রিয়। ফেয়ারনেস ক্রিম শুধু নারীতেই থেমে থাকেনি বরং এখন পুরুষের জন্যও ফেয়ারনেস ক্রিম পাওয়া যায়। বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের বেশ জনপ্রিয় একজন ক্রিকেটার এই মিডিয়া ক্যাম্পেইনে আছেন। তবে গবেষণায় দেখা গেছে, অধিকাংশ রঙ ফরসাকারী পণ্যে মারকিউরাস ক্লোরাইডের মতো অ্যাকটিভ ইনগ্রেডিয়েন্টস ব্যবহার করা হয়, যা ত্বকের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। সম্প্রতি ভারতের সেন্টার ফর সায়েন্স অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টের (সিএসই) পলিউশন মনিটরিং ল্যাব-এ পরীক্ষা করা সবকটি ফেয়ারনেস ক্রিমেই পারদের পরিমাণ পাওয়া গিয়েছে ৪৪ শতাংশেরও বেশি। অন্যান্য প্রসাধনী দ্রব্যে সামান্য পরিমাণের পারদ থাকে কিন্তু ফেয়ারনেস ক্রিমে অতিরিক্ত পরিমাণে পারদ থাকে৷ যার ফলে কিছুদিন ফেয়ারনেস ক্রিম ব্যবহার করলে ত্বকের নানান সমস্যা দেখা দেয়৷ বাজারে প্রথম সারির মোট ১৪টি ফেয়ারনেস ক্রিমের উপর এই পরীক্ষা চালানো হয়। সিএসই-র ডিরেক্টর জেনারেল সুনীতা নারায়ণ বলেছেন, "কসমেটিক্সে পারদ ব্যবহার সম্পূর্ণ ভাবে অনৈতিক ও বেআইনি।"
প্রশ্ন জাগে এসব ক্রিম কি সত্যিই কোনো কাজে আসে? প্রাথমিক ভাবে এইসব ফেয়ারনেস ক্রিম ব্যবহারের ফলে সাময়িক ভাবে ত্বকের রং কিছুটা ফর্সা হলেও দীর্ঘমেয়াদে ব্যবহার করলে ত্বকের ক্ষতি মোটামুটি নিশ্চিত। ত্বকের জন্য ক্ষতিকর এই সকল রং ফর্সাকারী ক্রিম ব্যবহারকারীরা ভাবতের পারেন এই ক্রিম ব্যবহারের ফলে তাদের ত্বকের রঙে পরিবর্তন এসেছে। আগের চেয়ে একটু ফরসা দেখা যাচ্ছে (আসলে ফ্যাকাসে)। কিন্তু এর বিনিময়ে কতটুকু মূল্য দিয়ে যাচ্ছেন, সেটা জানা আছে তো? সকলের জানা দরকার যে রঙ ফরসাকারী ক্রিম সবার জন্যই ক্ষতিকর।ফর্সা হওয়ার ক্রিম আপনার জীবনে ডেকে আনতে পারে চরম বিপর্যয়। এমনটাই জানাচ্ছেন বৈজ্ঞানিকরা। গবেষণায় দেখা গিয়েছে প্রায় সব ফর্সা হওয়ার ক্রিমেই মেশানো থাকে পারা। যার থেকে ত্বকের অ্যালার্জি, র্যাশ এমনকি ক্যানসারও হতে পারে। গবেষণায় দেখা গেছে, অধিকাংশ রঙ ফরসাকারী পণ্যে মারকিউরাস ক্লোরাইডের মতো অ্যাকটিভ ইনগ্রেডিয়েন্টস ব্যবহার করা হয়, যা ত্বকের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। মারকিউরাস ক্লোরাইড মূলত ব্লিচের কাজ করে, আর এটাই ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। তাই এ ধরনের ক্রিম নিয়মিত ব্যবহার করলে ত্বক পাতলা হয়ে যায় ও টানটান ভাব হারায়। এতে ব্রণও সৃষ্টি হয়। এছাড়াও ফেয়ারনেস ক্রিম ত্বককে ফটোসেনসেটিভ বা আলোক সংবেদনশীল করে তোলে। তাই এ ধরনের ত্বকে সূর্যের রশ্মি তুলনামূলক বেশি প্রভাব ফেলে এবং গুটি ও খুজলি তৈরি হয়। এছাড়া অনেক সংবেদনশীল ত্বকে অয়েল প্যাক, ফেশিয়াল কিংবা ম্যাসাজ করলেও পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে। একটি প্রশ্ন তাহলে রয়েই যায়, সত্যিই কী ত্বকের রঙ পরিবর্তন করার জন্য সম্পূর্ণ নিরাপদ কোনো পদ্ধতি নেই? হ্যাঁ, আছে। জাপান ও ইউরোপে বর্তমানে বেশ কিছু কার্যকরী ক্রিম পাওয়া যাচ্ছে, তবে এগুলোকে আসলে ক্রিম না বললে উচ্চমূল্যের ওষুধ বলাই ভালো, যা মেলানিনকে কোনো পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া ছাড়াই প্রভাবিত করতে পারে। অবশ্য এসব ব্যবহারের আগে ডাক্তারের যথাযথ নির্দেশনা প্রয়োজন। বর্তমানে মেয়েদের পাশা পাশি রুষদের ফেয়ারনেস নিয়েও বেশ চিন্তিত হয়ে পড়েছে কোম্পানিগুলো। কিন্তু মনে রাখা ভালো, পুরুষ ও নারীর ত্বকে খুব বেশি পার্থক্য নেই। উল্টো ছেলেদের ফেয়ারনেস ক্রিমে অধিক পরিমাণে ব্লিচ ব্যবহার করার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হিসেবে ব্রণ বেশি হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
তার পরও অনেকে নিজের ত্বক ফরসা করার ত্যাগ হিসেবে এ ক্ষতি মেনে নেন। তাই ফেয়ারনেস ক্রিমের মায়া তারা ছাড়তে পারেন না। কিন্তু তাদেরও জেনে রাখা ভালো, ব্লিচিং শুধু সাময়িক ফরসা করতে পারে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে ভালো ত্বকের জন্য জরুরি পিগমেন্টেশন কমানো, যা ফেয়ারনেস ক্রিমের পক্ষে সম্ভব নয়। তা ছাড়া এটা মনে রাখা ভালো যে ড্যামেজ ফরসা ত্বকের চেয়ে তুলনামূলক কম ফরসা নিখুঁত ত্বক অনেক বেশি আকর্ষণীয় ও কাঙ্ক্ষিত। তা ছাড়া একজন নর বা নারী যদি শিক্ষা-মেধা সহ অন্যান্য গুণাবলি থাকে, তাহলে তারা কেন ফেয়ারনেস ক্রিম ব্যবহার করবেন? তাহলে কি ফর্সা হওয়াটাই কি সব? সুতরাং সাত দিনে ফর্সা হতে চান? টিভি বিজ্ঞাপনের চটকে ভোলার আগে দু-বার ভাবুন। এখনও সময় আছে। সতর্ক হোন। তথাকথিত সুন্দরী হওয়ার আকাঙ্খা আপনাকে মারাত্মক সর্বনাশের দিকে ঠেলে দিচ্ছে না তো? কারণ সচেতনতার বিকল্প নাই। আজ থেকেই বিরত থাকুন তথা কথিত এই সকল রং ফর্সা করা ক্রীম যার বেশীর ভাগ ত্বকের জন্য মারাত্বক ক্ষতিকর।