আপনি আছেন » প্রচ্ছদ » খবর

কলেজ অধ্যক্ষের পদে লিঙ্গান্তরকারী!

প্রথমবারের মতো কলেজ অধ্যক্ষের পদে কোনো লিঙ্গ পরিবর্তনকারী ব্যক্তিকে পেতে যাচ্ছে ভারত। মানবী বন্দ্যোপাধ্যায় নামের ওই নারী পশ্চিমবঙ্গের বাসিন্দা, দায়িত্ব পাচ্ছেন নদীয়া জেলার কৃষ্ণনগর উইমেনস কলেজের। আগামী ৯ জুন পদটিতে যোগ দিতে যাওয়া মানবী হিন্দুস্তান টাইমসকে বলেন, ‘আমার জন্য এটা অজ্ঞতার বিরুদ্ধে এক সুদীর্ঘ যুদ্ধ। একটা সময় ছিল যখন আমি এমনকি আমার বাবার কাছ থেকেও ঘৃণ্যরকমের হুমকি পেয়েছিলাম লিঙ্গ পরিবর্তন করতে গেলে ফল কী হবে, তা নিয়ে। আমি আমার শৈশব কাটিয়েছি নদীয়ায় এবং দীর্ঘদিনের যুদ্ধের পর আমি মর্যাদা ও গর্বের সাথে নিজের বাড়িতে ফিরে আসতে পেরেছি।’ অবশ্য কর্মক্ষেত্র এটাই প্রথম নয়, পশ্চিমবঙ্গের এক সহযোগী অধ্যাপক হিসেবে বিবেকানন্দ শতবর্ষী মহাবিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে বর্তমানে কর্মরত আছেন মানবী বন্দ্যোপাধ্যায়। লিঙ্গান্তরকারী সম্প্রদায়ের জন্য একটি উদাহরণ সৃষ্টি করেছেন তিনি, গড়েছেন নতুন ইতিহাস। ১৯৯৫ সালে দেশটির ইতিহাসে প্রথমবারের মতো কোনো লিঙ্গান্তরকারী পত্রিকা প্রকাশ করেন তিনি- ‘ওব-মানব’, যার বাংলা অর্থ করলে দাঁড়ায় উপ-মানব। খুব একটা কাটতি না থাকলেও এখনো প্রকাশিত হচ্ছে পত্রিকাটি। পশ্চিমবঙ্গে লিঙ্গ পরিবর্তন করা প্রথম কোনো অধ্যাপকও মানবীই এবং এই গোষ্ঠীর ব্যক্তিদের মধ্যেও তিনি প্রথম পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেন। কিন্তু এর বিনিময়ে প্রাপ্য সম্মানের বদলে বরং তিনি সবসময়েই হুমকি আর অপমান পেয়ে এসেছেন বলে জানান। ২০০৫ সালে লিঙ্গান্তরকারী ব্যক্তিদের ওপর গবেষণার মাধ্যমেই পিএইচডি লাভ করেন তিনি। বাংলায় স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করার পর ঝাড়গ্রাম উপ-বিভাগের বিবেকানন্দ শতবর্ষী মহাবিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগেই প্রভাষক হিসেবে নব্বইয়ের দশকে যোগ দিয়েছিলেন মাধবী। কিন্তু কর্মক্ষেত্রে যোগ দেয়ার পর প্রথম দিন থেকেই সহকর্মীদের কাছ থেকে দারুণ অসহযোগিতা পেয়ে গেছেন তিনি। পুরোনো দিনের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে তিনি বলেন, ‘আমার সহকর্মী এবং ছাত্র ইউনিয়নের নেতাদের কাছ থেকে আমি আর আমার বাবা হুমকি পেতাম। তাদের দাবি ছিল যে আমাকে একজন পুরুষ প্রভাষক হিসেবে কাজে যোগ দিতে হবে। যখন আমি প্রতিবাদ করেছি, তারা আমাকে আর আমার বাবাকে হত্যার চেষ্টা করেছে এবং ঝাড়গ্রামে যেন আমি বাড়িভাড়া না পাই, তাও নিশ্চিত করেছে।’ এরপর থেকে তিনি যতো জায়গায় গিয়েছে, সব জায়গাতেই একই রকমের সমস্যায় পড়ায় সিদ্ধান্ত নেন- অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে পাকাপাকিভাবে লিঙ্গ পরিবর্তনের। পশ্চিমবঙ্গে লিঙ্গ পরিবর্তন ইতিহাসের একদম শুরুর দিকেই এই তালিকায় নাম লেখানো মানবী বলেন, ‘একজন পরিপূর্ণ নারী হওয়ার জন্য ২০০৩ ও ২০০৪ সালে ধারাবাহিকভাবে বেশ কয়েকটি অস্ত্রোপচারের মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে আমাকে। ২০০৪ সালে জন্মের সময়য় পিতৃপ্রদত্ত নাম- সোমনাথ বদলে মানবী নাম নেই আমি, যার আক্ষরিক অর্থও নারী-মানুষ। এটা ছিল আমার জন্য এক বিস্ময়কর অভিজ্ঞতা।’ নতুন পদে যোগদানের আগে চলতি সপ্তাহেই কৃষ্ণনগর উইমেনস কলেজে নিজের দত্তক নেয়া ছেলে দেবাশীষ মানবীপুত্র এবং লিঙ্গ পরিবর্তনকারী বন্ধু জ্যোতি সামান্তাকে সাথে নিয়ে গিয়েছিলেন মানবী। তিনি বলেন, ‘এটা কোনো পদ নয়, যা আমি বহু প্রতীক্ষা আর লড়াইয়ের পর পেয়েছি। এটা একটি অর্জন এবং এর মর্যাদাই গুরুত্বপূর্ণ ও মুখ্য।’ গত বছরের এপ্রিল মাসে ভারতের সর্বোচ্চ আদালত লিঙ্গ পরিবর্তনকারীদের তৃতীয় লিঙ্গ হিসেবে স্বীকৃতির নির্দেশ দিয়ে ইতিহাস গড়ে। যারা নিজেদের না নারী, না পুরুষ বলে চিহ্নিত করেন, তাদেরও মানবাধিকার রয়েছে বলে আদালতের দেয়া নির্দেশে আরো বলা হয়, ‘প্রত্যেক ব্যক্তির অধিকার রয়েছে নিজস্ব লিঙ্গ চিহ্নিত করার।’ লিঙ্গ পরিবর্তনকারীদের জন্য শিক্ষাক্ষেত্র ও কর্মক্ষেত্রে অন্যান্য সংখ্যালঘুদের মতোই কোটা পদ্ধতি প্রণয়নের জন্য প্রয়োজনীয় নির্দেশ দেন দেশটির আদালত। বর্তমানে ভারতে প্রায় ২০ লাখ লিঙ্গ পরিবর্তনকারী রয়েছেন বলে ধারণা করা হয়।