খুব পরিচিত একটি গান। `বৃহস্পতি আমার এখন তুঙ্গে/ শনির দশা শেষ হয়েছে কবে?' গানটি এখন বুঝি গাইতে হবে এমন করে-বৃহস্পতির চাঁদে জীবন তুঙ্গে/ মঙ্গলটা পুরাতন সেই কবে!
মঙ্গলে লোনা পানির অস্ত্বিত্ব আর জীবন সম্ভাবনার উত্তেজনা শেষ না হতেই ছক্কা মেরে দিয়েছে সৌরজগতের বৃহত্তম গ্রহ বৃহস্পতি। যেখানে মঙ্গলে জীবনের সম্ভাবনা নিয়ে `যদি', `কিন্তু' বিদ্যমান, সেখানে বৃহস্পতি’র চারটি চাঁদের মধ্যে দুই চাঁদ ‘ইউরোপা’ এবং ‘গ্যানিমিড’ এ ‘অতল’ জলের সন্ধানতো মিলেছেই, পাশাপাশি এ সম্ভাবনাও প্রায় নিশ্চিত সেই অতলে অন্তত তিনশ কোটি অনুজীব রয়েছে।
বাঙালি মহাকাশবিজ্ঞানী হিল্লোল গুপ্তের বরাত দিয়ে ভারতীয় বাংলা সংবাদপত্র দৈনিক আনন্দবাজার মঙ্গলবার এ কথা জানিয়েছে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মেরিল্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ইউএমবিসি সেন্টারের কম্পিউটার ও মহাকাশবিজ্ঞানী হিল্লোল গুপ্ত জানান, ‘প্রাণের জন্য জলকে তরল অবস্থায় থাকতেই হবে, আর সেই জলকে পর্যাপ্ত হতে হবে, এটা যেমন ঠিক, তেমনই তরল অবস্থায় জলের হদিশ মিললেই যে প্রাণের সৃষ্টি হবে, তা কিন্তু জোর দিয়ে বলা যায় না। ‘প্রাণে’র জন্মের জন্য পর্যাপ্ত অক্সিজেনেরও প্রয়োজন। আর সেই অক্সিজেনকে পর্যাপ্ত পরিমাণে গ্যাসীয় অবস্থাতেই থাকতে হবে। এখনও পর্যন্ত যে সব তথ্য পাওয়া গিয়েছে, তাতে মঙ্গলের তুলনায় অক্সিজেন গ্যাস অনেক বেশি পরিমাণে রয়েছে বৃহস্পতির দুই ‘চাঁদ’— ‘ইউরোপা’ আর ‘গ্যানিমিড’-এ।
তাই, মঙ্গলে তরল জল মিললেও ‘প্রাণ’ এর সন্ধান মিলবে কতটা, তা নিয়ে সংশয় রয়েছে। অন্যদিকে, বৃহস্পতির দুই চাঁদে এত বেশি পরিমাণে অক্সিজেন গ্যাস রয়েছে, তাতে সেখানে অণুজীব না থাকলে, সেটাই হবে বিস্ময়ের’।
চলতি মাসে পোয়ের্তোরিকোয়, ‘আমেরিকান অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল সোসাইটি’র ‘ডিভিশন ফর প্ল্যানেটারি সায়েন্সেস’-এর ৪১তম বৈঠকে একটি চাঞ্চল্যকর গবেষণাপত্র পেশ করেছেন অ্যারিজোনা বিশ্ববিদ্যালয়ের জ্যোতির্বিজ্ঞানের বিশিষ্ট অধ্যাপক রিচার্ড গ্রিনবার্গ। ওই গবেষণাপত্রটি তৈরি করার ক্ষেত্রে হিল্লোল গুপ্ত ছিলেন গ্রিনবার্গের সহকারী।
হিল্লোল গুপ্তের ভাষ্য, বৃহস্পতির দু’টি ‘চাঁদ’— ‘ইউরোপা’ আর ‘গ্যানিমিড’-এ রয়েছে প্রচুর অক্সিজেন এবং হাইড্রোজেন গ্যাস। অভাব নেই কার্বন, নাইট্রোজেন, সালফার ও ফসফরাসের মতো প্রচুর রাসায়নিক মৌলের। অন্তত, কার্বন আর নাইট্রোজেনের পরিমাণ মঙ্গলের থেকে অনেকটাই বেশি। বৃহস্পতির দুই ‘চাঁদে’র ‘বায়ুমণ্ডলে’ প্রচুর পরিমাণে অক্সিজেন রয়েছে বলে কার্বন, নাইট্রোজেন, সালফার ও ফসফরাস-ঘটিত যৌগেরও অভাব নেই সেখানে। যে মহাসাগর বা ‘ওশান’গুলো রয়েছে বৃহস্পতির দুই ‘চাঁদে’, তার গভীরতা আমাদের আটলান্টিক বা প্রশান্ত মহাসাগরের তুলনায় প্রায় দশ থেকে পনেরো গুন। বৃহস্পতির ‘চাঁদ’ এর মহাসাগরগুলি তার পিঠের পুরু ও লোহার মতো শক্ত বরফের চাদরের খুব একটা নিচে নেই।
সেই বরফের চাদরের মাত্র ৯৫ থেকে ১১৫ মাইল নিচেই রয়েছে তরল জলের ওই সুবিশাল মহাসাগরগুলি। সেই পানিও নোনা। পৃথিবীর মতোই।
অধ্যাপক গ্রিনবার্গের গবেষণাপত্রে একেবারে হিসেব কষে দেখানো হয়েছে, বৃহস্পতির দুই ‘চাঁদে’, ওই পরিবেশে এখনও কম করে ৩০০ কোটি অণুজীব বেঁচে থাকতে পারে। সেই অণুজীব হতে পারে ‘মাইক্রো-ফ্লোরা’ বা, অণু-উদ্ভিদ, আবার তা ‘মাইক্রো-ফনা’ বা, অণু-প্রাণীও হতে পারে। তা সে ‘প্রাণী’ই হোক বা, ‘উদ্ভিদ’, সেগুলির এককোষী বা, ‘ইউনি-সেলুলার’ হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। সূর্য থেকে এত দূরে, তা-ও আবার অতটা পুরু বরফের ‘চাদর’ তলে ‘লুকিয়ে থাকা’ মহাসাগরের ৯০ থেকে ১৫০ মাইল নিচে, ‘ইউরোপা’ ও ‘গ্যানিমিড’-এ বহুকোষী প্রাণী বা উদ্ভিদের হদিশ মেলাটা কার্যত, অসম্ভবই।
অধ্যাপক গ্রিনবার্গের গবেষণাপত্রে ‘জীবন’ এর সম্ভাবনার দৌড়ে মঙ্গলের চেয়ে বৃহস্পতির চাঁদদ্বয়কে এগিয়ে রাখা হয়েছে আরও একটি কারণে। তা হল,সেই হাইড্রোজেন পার-অক্সাইড গ্যাস প্রচুর পরিমাণে রয়েছে বৃহস্পতির ওই দুই ‘চাঁদে’। এখনও পর্যন্ত পাওয়া তথ্য বলছে, সেই হাইড্রোজেন পার-অক্সাইড গ্যাস দুই চাঁদের পিঠে পুরু বরফের নীচে থাকা মহাসাগরের তরল জলে মিশেছে। এখনও মিশছে। এটাই ‘প্রাণ’ সৃষ্টির জন্য প্রয়োজনীয় শক্তির ভাণ্ডারের জন্ম দিয়েছে বৃহস্পতির দুই চাঁদে।
হিল্লোল গুপ্ত আরো জানান, ‘বৃহস্পতির’ দুই চাঁদে তরল জল যে প্রায় প্রতি মুহূর্তেই ফুটে চলেছে তার প্রমাণ মিলেছে। জল ফুটছে বলেই দুই ‘চাঁদে’র দুই মেরু থেকে প্রচুর পরিমাণে জলীয় বাষ্প বেরিয়ে আসতে দেখা গিয়েছে। হাব্ল স্পেস টেলিস্কোপে সেই ছবি ধরাও পড়েছে। জোরালো অভিকর্ষ বল আর মহাসাগরগুলির নিচে থাকা ‘জীবন্ত’ আগ্নেয়গিরিই বৃহস্পতির দুই ‘চাঁদে’ তরল জলকে ফুটিয়ে প্রচুর জলীয় বাষ্পের জন্ম দিচ্ছে।