আপনি আছেন » প্রচ্ছদ » খবর

জেনে নিন পটল কুমার গান ওয়ালার পটলের কিছু কথা

—পটলকুমার তো গায়ক। পটল ছাড়া অন্য কোনও কুমার-কে তুই চিনিস?
হ্যাঁ-অ্যা...সুজনকুমার।
—সে তো তোর সিরিয়ালের বাবা, কিন্তু এমনি এমনি কোনও কুমার নামের লোককে চিনিস?
নাহ্। কাউকে চিনি না।
—কিশোরকুমার, অমিতকুমার কুমার শানু?
চিনি না গো।
—আচ্ছা, উত্তমকুমার?
উত্তম তো আমার বাবা। উত্তম দে। মায়ের নাম শ্রাবণী। শ্রাবণী দে।
....এই হল পটল। ছোট্ট পাখির মতো পাতলা একরত্তি মেয়ে। ছয় পেরিয়ে সাতে পড়েছে নভেম্বরের একুশে। সিরিয়ালে সে সারাক্ষণ ছেলে সেজে রয়েছে।
শৈশবের মিঠে রোদ ছড়িয়ে স্টুডিওর মেকআপ রুমে ছুট্টে এসে চড়ে বসল আমার কোলে। বলল, ‘‘জানো আন্টি, আমার জন্য প্রেসের লোক আসবে!’’
দীর্ঘ সাংবাদিকতার জীবনে কাউকে কোলে বসিয়ে সাক্ষাৎকার এই প্রথম। বললাম, প্রেসের লোক মানে কী রে?
‘‘আরে ওই যে মাইক হাতে এসে জানতে চায় না...কী করি...কী খাই... কী গাই...এই সব।’’
মধুমাখা সারল্যের সামনে আর কোনও প্রশ্ন হয়? বুঝলাম হাতে ‘বুম’ না থাকায় কথাবার্তা চলবে সহজে।
—তোর ভাল নাম কী?
‘‘হিয়া দে। বাবা ডাকে দুষ্টু বলে। দুষ্টু আমার ডাকনাম।’’
—কেন, খুব দুষ্টু নাকি তুই?
দুধের দাঁত পড়ে গিয়ে সামনের দাঁতদু’টি দেখলেই বোঝা যায় সদ্য উঠেছে। বাকিগুলো এখনও পড়া বাকি। ঈষৎ উঁচুনিচু সেই মুক্তো হাসি, হাতের ছোট্ট তালু দিয়ে ঢাকার চেষ্টা করতে করতে কোল থেকে নেমে বলল, ‘‘চলো তোমাকে গোয়েন্দা-আন্টির সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিই।’’
কিছু বলার আগেই হাত ধরে টেনে নিয়ে চলল ঠিক পাশের ফ্লোরে। পটলের গোয়েন্দা-আন্টি মানে ইন্দ্রাণী হালদার সেখানে শুটিং করছেন।
হায় ছেলেমানুষি! ও জানে না, ইন্দ্রাণীর গনগনে রোদের মধ্যে নিজের ভোরের নরম আলোকে হারিয়ে যেতে দিতে নেই। ‘পটলকুমার গানওয়ালা’ সম্পর্কে বলতে গিয়ে ঢুকে পড়তে নেই পাশের ‘গোয়েন্দা গিন্নির’ ঘরে। এ ভাবে মেশাতে নেই দুই ধারাবাহিক, দুই চ্যানেলকে। কিন্তু সাহসী সারল্য সেই বিভেদ সরিয়ে দেয় উড়ে যাওয়া এক ঝাঁক পায়রার মতো!
—আচ্ছা, এই যে ছুট করাচ্ছিস...তোর নিজের বন্ধুদের সঙ্গে এখন আর ছুটে ছুটে খেলতে পারিস? সময় পাস?
‘‘না, পারি না। সময় পাই না গো। স্কুলেই যেতে পারি না তিন মাস ধরে’’...বলতে বলতে সে সবে ঢুকতে যাবে ফ্লোরে, হঠাৎই আমাকে টেনে ধরে বলল ‘‘দাঁড়াও...চুপি চুপি...কথা বোলো না..., চুপটি করে থাকো।’’
—কোন স্কুলে পড়িস তুই?
‘‘শট চলছে... কথা বোলো না। (ফিস ফিস করে) কমলা গার্লস। (একটু পরেই)...ওই তো কাট্ বলে দিয়েছে ‘কাট্-আঙ্কল’...চলো চলো।’’
পুতুলের মতো মেয়েটাকে দেখলে কে বলবে ‘পটলকুমার গানওয়ালা’ ধারাবাহিকের দৌলতে সে এখন স্টার জলসার সবচেয়ে বেশি টিআরপি ধরে রেখেছে। ও দিকে জি বাংলার সেই টিআরপি ধরে রেখেছেন জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত অভিনেত্রী ইন্দ্রাণী।
প্রতিভা সত্যিই সীমানা মানে না! ইন্দ্রাণীর কোলে চেপে দিব্যি পোজ দিল পটল বা হিয়া। আমাকে দেখিয়ে বলল, ‘‘এটা নতুন আন্টি।’’ ইন্দ্রাণী হেসে বললেন, ‘‘কী সুন্দর এক্সপ্রেশন দিতে শিখে গেছে এই বয়সেই।’’
একটু পরে, কোল থেকে নেমে এ দিক সেদিক ছোটাছুটি করে বেরিয়ে এল সে। ভারতলক্ষ্মী স্টুডিওর সিঁড়ির রেলিং-এ একটু স্লিপ খেয়ে নিল। কোথা থেকে একটা একতারা নিয়ে এসে বলল, ‘‘এটা নিয়ে আমার ছবি তুলবে গো? এটা বাউলদাদু বাজায়।’’


বোঝা গেল, ধারাবাহিকের জীবন আর বাস্তব... মিলেমিশে গেছে ছোট্ট মেয়েটার মনের মধ্যে।
কখন সে হিয়া আর কখন সে পটল... নিজেও জানে না।
মেকআপ রুমে ফিরে এসে ওর মায়ের কাছে জানতে চাইলাম —আচ্ছা, ও নিজের হাতে খেতে পারে? মাছ বাছতে পারে?
‘‘না-না। আমিই খাইয়ে দিই।’’
ততক্ষণে মায়ের মোবাইলে ক্যান্ডিক্রাশ খেলতে শুরু করেছে হিয়া।
—স্কুলে তো যেতে পারছে না তিন মাস। পরীক্ষা-টরিক্ষার কী হবে?
মা বললেন, ‘‘স্কুল সাহায্য করছে। নভেম্বরে ক্লাস ওয়ানের ফাইনালটা দিতে পারেনি, তাও টু-এ তুলে দিয়েছে। তা ছাড়া আমি গিয়ে পড়াটড়া লিখে নিয়ে আসি। মাসের দ্বিতীয় শনিবার, আর টুকটাক ছুটি পেলে সেই দিনগুলো পড়াই...।’’
আপাতত এ ভাবেই চলছে পটলকুমারের শৈশব। মুকুন্দপুরের দোতলা বাড়িতে বাবা-মা-দিদি-ঠাকুমা-ঠাকুরদার কাছে সে শুধু বাড়ি ফেরে ঘুমোনোর জন্য। তার পর সারা দিন কেটে যায় স্টুডিওয়।
মাসের মধ্যে তার কাজ থাকে প্রায় সাতাশ থেকে আঠাশ দিন। জানা গেল কোনও কোনও দিন কাজের পরে রাত বারোটায় বাড়ি ফিরে, পর দিন হয়তো সকাল আটটা-ন’টায় চলে আসতে হয়। সঙ্গে মা আসেন। রোজ। সন্তোষপুরে মুদিখানার দোকান বাবার। মেয়ে-বৌকে মোটরবাইকে চাপিয়ে স্টুডিওয় নামিয়ে দিয়ে দোকানে চলে যান তিনি।
—সারা দিন কাজ করে ভোরে ঘুম থেকে উঠতে কষ্ট হয় না হিয়া?
(মায়ের দিকে একবার তাকিয়ে)
‘‘না, হয় না।’’
—আচ্ছা, মেয়ে হয়ে ছেলে সেজে অভিনয় করতে তোর ভাল লাগে?
(আবার মায়ের দিকে চেয়ে)
‘‘হ্যাঁ, খুব ভাল লাগে।’’
—বেশ। তুই তো গায়ক সাজছিস। এমনিতে কোনও গান শুনিস?
‘‘হ্যাঁ, ‘গান গাই আর মনরে বোঝাই...’ শুনি তো’’
—এটা তো সিরিয়ালের গান? অন্য কোনও গান?
‘‘জানি না গো।’’
—নাচ শিখিস? আঁকা? আবৃত্তি?
‘‘না। শিখি না।’’
পাশ থেকে ওর মা বললেন, ‘‘ওকে একটা প্রতিষ্ঠানে অভিনয় শিখতে পাঠিয়েছিলাম কিছু দিনের জন্য...আসলে ওকে অভিনেত্রীই করে তুলতে চাই।’’
তা তো ঠিক আছে, কিন্তু দেখা গেছে শিশুশিল্পীরা বেশির ভাগ সময়ই হারিয়ে যায়।
মা বললেন, ‘‘দেখা যাক কী হয়।’’
জানা গেল, রাত সাড়ে ন’টার মধ্যে শুটিং শেষ হলে বাড়ি ফেরার জন্য ইউনিটের গাড়ি পায় হিয়া। কিন্তু তার আগে যেতে হলে অটো, বাসই ভরসা। তাও শীতকালে টুপি পরিয়ে আনা হত বলে লোকে চিনতে পারত না। এখন গরম। পথে ঘাটে লোকে চিনে ফেলছে। সেই জন্য ট্যাক্সিতেই বাড়ি ফিরতে হচ্ছে হিয়া ও তার মাকে।
—হিয়া, তুই স্বপ্ন দেখিস?
‘‘হ্যাঁ।’’
—একটা হ্যাপি-হ্যাপি স্বপ্ন বল তো?
‘‘আমার হ্যাপি বার্থ ডে-তে কেক কাটা হচ্ছে। লোকে গিফ্ট দিচ্ছে।’’
—এ তো এমনিতেও হতে পারে। কিন্তু কী এমন স্বপ্ন আছে যা তুই দেখতে চাস?
‘‘দেব। দেবের সঙ্গে হ্যান্ডশেক করতে চাই। ছবি তুলতে চাই।’’
—আর কোনও হিরোকে চিনিস না?
‘‘না। শুধু দেবকেই চিনি।’’
—ওকে বিয়ে করবি? নাকি ওর সঙ্গে অভিনয় করবি?
‘‘এমা। কত বড়। নাহ্ বিয়ে করব না। শুধু ছবি তুলব।’’
হাঁটতে হাঁটতে মেকআপ রুমের বাইরে চলে আসে হিয়া। ততক্ষণে শুটিং-এ এসে পড়েছে সাহেব চট্টোপাধ্যায়, যে আবার সিরিয়ালে পটলের বাবা সুজনকুমার। ছুট্টে গিয়ে তাঁর পিঠে উঠে পড়ে পটল। বলল, ‘‘আন্টি, এই হল সুজনকুমার। আমার বাবা।’’ হিয়ার কথায় হেসে ফেলে সবাই। পাশেই দাঁড়িয়ে তার সত্যিকারের বাবা-মা।
কথা-গল্প শেষে বাবা-মা-মেয়ে বেরিয়ে যায় বাইকে চেপে।
দুঃখের কথা, বাবা-মায়ের মাথায় হেলমেট থাকলেও হিয়ার মাথায় ছিল না হেলমেট।
পরে ফোনে ওর মাকে বললাম, হিয়াকে হেলমেটটা পরাবেন প্লিজ!
মা বললেন, ‘‘ঠিক বলেছেন দিদি, এ বার থেকে পরাব।’’

- খবর আনন্দ বাজার পত্রিকা